ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর যে কারণে দরকার

তন্ময় চৌধুরী •


বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন দেশের প্রায় আট কোটি বাস্তুচ্যুত মানুষের মধ্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অধিক ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর প্রবল নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। শুরুতেই বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় লোকজনসহ সর্বস্তরের মানুষ ত্রাণ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে এবং কক্সবাজারের বনভূমি ও কৃষিজমিতে রোহিঙ্গাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে। প্রতিবছর ৩০ হাজারের বেশি শিশু জন্মগ্রহণের পাশাপাশি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০ থেকে ৭০ হাজার জন বাস করায় সেখানে ‘স্থানসংকট’ প্রকট রূপ ধারণ করছে।

পরবর্তী সময়ে স্থানীয় ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করতে ও রোহিঙ্গাদের জন্য উন্নততর বাসস্থানের ব্যবস্থা হিসেবে ভাসানচর প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ, যা বিশ্বে শরণার্থী ব্যবস্থাপনার জন্য এক অনন্য মডেল।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক জান্তার সহিংস উচ্ছেদ অভিযানের কারণে রোহিঙ্গারা যখন নিঃস্ব ও রক্তাক্ত অবস্থায় বাংলাদেশ সীমানায় প্রবেশ করে, তাত্ক্ষণিকভাবে প্রায় ছয় হাজার একর বনভূমি ও পাহাড় কেটে তাদের জন্য সাময়িক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।

ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততায় রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা শুরু করে বাংলাদেশ সরকার। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক হওয়ায় সে দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মিয়ানমারের অনিচ্ছা ও অসহযোগিতার কারণে দীর্ঘ চার বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

তত দিনে কক্সবাজার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয় ও রোহিঙ্গা কর্তৃক সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে, যা শান্তিকামী স্থানীয় জনগণ ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই খুব পীড়াদায়ক।

ইউনিসেফের তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এরই মধ্যে প্রায় ৬০ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এখন রোহিঙ্গা আসার পর থেকে নির্বিচারে বন ও পাহাড় কাটায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি আরো ত্বরান্বিত হচ্ছে।

বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়াসহ জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যের পরিবর্তনের কারণে কক্সবাজারে পানির স্তর এরই মধ্যে অনেক নিচে নেমে গেছে। বন্য হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় প্রায়ই তারা লোকালয়ে চলে আসে এবং বসবাসরতদের জন্য জীবননাশের হুমকি তৈরি করে।

কক্সবাজার জেলায় মোট এক হাজার ১৫৬ ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী থাকলেও রোহিঙ্গাদের উপস্থিতিতে তাদের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেগুলো ঝুঁকিতে পড়ার পাশাপাশি বিলুপ্তির মুখোমুখি হচ্ছে।

১১ লাখ রোহিঙ্গার উদ্বৃত্ত আবর্জনা কৃষিজমিতে স্তূপ করায় তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে পরিকল্পিত ও বসবাসযোগ্য আবাসস্থল হিসেবে ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তরিত হলে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় লোকজনের জনজীবন এবং জীববৈচিত্র্য দুটিই ব্যবস্থাপনা করা বাংলাদেশের পক্ষে সহজ হবে।

পরিবেশগত বিপর্যয় ছাড়াও স্থানীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতির দিকে আলোকপাত করলে যে ভয়ংকর দৃশ্য সামনে আসে, তাতে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা একসঙ্গে থাকায় ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজেদের মধ্যেই হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ১৯ হাজার শান্তিকামী রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় উন্নততর ও সুব্যবস্থাসম্পন্ন ভাসানচরে গিয়ে নিরাপদ জীবন পরিচালনা করছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত চার বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধের কারণে মামলা ও আসামির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে।

২০১৭ সাল থেকে ক্রমবৃদ্ধি পেয়ে শুধু ২০২০ সালেই দেখা যায় অস্ত্র মামলা ২৭টি, মাদক মামলা ২৫৬টি, ধর্ষণ মামলা ১১টি, অপহরণ মামলা চারটি, ডাকাতি মামলা একটি, হত্যা মামলা ১৩টি, মানবপাচার মামলা তিনটি এবং অন্যান্য মামলা ২৭টি। অনেক রোহিঙ্গা তাদের স্বগোত্রীয় অপরাধীদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে নিরাপদ জীবনযাপনের আশায় ভাসানচরে স্থানান্তরিত হতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও কিছু আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন ও সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর প্রলোভন, হুমকি ও ভাসানচর সম্পর্কে গুজব ছড়ানোর কারণে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তরিত হলে কক্সবাজার ক্যাম্পগুলোতে বেশ কিছুটা খোলামেলা পরিবেশ তৈরি হবে।

ফলে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোকে পর্যবেক্ষণ ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে। ভাসানচর সমতল ভূমি হওয়ায় রোহিঙ্গা কর্তৃক বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তুলনামূলক কম হবে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন। তাই স্থানীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের উদ্যোগটি বাংলাদেশ সরকারের একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।

কক্সবাজারে সমতল ভূমি অপ্রতুল হওয়ায় পাহাড়বেষ্টিত বনভূমি ধ্বংস করে বানানো ঝুঁকিপূর্ণ অনেক ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা অবস্থান করায় প্রায়ই ঘটছে বিভিন্ন দুর্ঘটনা। প্রতিবছর বর্ষাকালে ভূমিধসের উচ্চঝুঁকিতে থাকে দুই হাজার ৮০০ হেক্টর উপত্যকা এলাকায় বসবাসরত হাজারো বাস্তুচ্যুত পরিবার।

কক্সবাজারে গত জুলাই মাসে ভূমিধসে রোহিঙ্গাসহ ২৩ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং অনেকে আহত হয়। অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা দেখা দিলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, যা বিভিন্ন রোগ তৈরির উৎস হিসেবে কাজ করে। গত জুলাই মাসে বন্যার কারণে চার শিশুসহ ১১ জন রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করে এবং চার হাজার ঘর পানিতে তলিয়ে যায়, যার ফলে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা আবাসহীন হয়ে পড়ে।

মাদক ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ থাকায় এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়ে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ক্যাম্পগুলোর অস্থায়ী ঘরগুলো লাগোয়া এবং দাহ্য পদার্থ বিশিষ্ট হওয়ায় আগুন দ্রুত এক ঘর থেকে অন্য ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে ভাসানচরের ঘরগুলো ইটের তৈরি এবং পরিকল্পিত হওয়ায় সে ধরনের ঝুঁকি অনেকটাই কম। তাই জীবনের ঝুঁকি কমাতে এবং উন্নততর ও নিরাপদ পরিবেশে জীবন নির্বাহে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যাওয়া উচিত। অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ভাসানচর থেকে পালিয়ে থাকে বলে শোনা যাচ্ছে, যাদের বেশির ভাগই মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত বা এর শিকার।

তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলোর ত্রাণ কার্যক্রম দ্রুত শুরু হলে ভাসানচরের প্রতি রোহিঙ্গাদের আগ্রহ আরো বাড়বে বলে মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেন।

বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শন শেষে ইইউ, ওআইসি এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা ও জীবনযাত্রার সার্বিক অবস্থা বিষয়ে খুবই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন এবং জাতিসংঘ ভাসানচরের সার্বিক কার্যক্রমে যুক্ত হবে বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে।

ভাসানচর একটি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা হওয়ার যেসব আপত্তি শুরুতে ছিল, তা সাম্প্রতিক সময়ে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ ও ‘ইয়াস’-এর পরবর্তী টেকসই ও সহনশীল ভাসানচরের চিত্র দ্বারা খণ্ডিত হয়। তাই শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরকে ‘শান্তির চর’ বললেও ভুল হবে না।

পরিকল্পিত ও প্রশস্ত আবাসন, স্কুল, মাঠ, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও সাইক্লোন শেল্টারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে ভাসানচরে। রোহিঙ্গাদের জীবন মানোন্নয়নে ভাসানচরে বর্তমানে ২২টি এনজিও সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলো কার্যক্রম শুরু করলে ১৬ হাজার একর ভাসানচরে আরো কর্মসংস্থানমূলক নতুন প্রচুর প্রকল্প (যেমন—মৎস্য আহরণ, গবাদি পশু পালন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কারখানা স্থাপন ইত্যাদি) বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে, যা কক্সবাজারের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পগুলোতে অসম্ভব।

ভাসানচরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য ‘চট্টগ্রাম-হাতিয়া থেকে ভাসানচরের সঙ্গে নৌযোগাযোগ উন্নয়ন’ নামে একটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

এতে ভাসানচর ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের মধ্যে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় পণ্য আনা-নেওয়া আরো সহজ হবে। প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাংলাদেশ সরকারের এমন মহৎ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আরো বেসরকারি সংগঠনগুলো দ্রুত সম্পৃক্ত হলে মিয়ানমারে গণহত্যা ও বীভৎস অবস্থার শিকার এই হতাশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘পোস্ট ট্রমাটিক গ্রোথ ও রেজিলিয়েন্স’ গঠন সহজ হবে।

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের একমাত্র উপায় হলো রোহিঙ্গাদের তাদের আদিনিবাস রাখাইনে প্রত্যাবাসন করা। কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক অভ্যুত্থান তাতে অনেকটা অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এমন অনিশ্চিত ও দীর্ঘ সময়ের জন্য ১১ লাখ রোহিঙ্গার জনাকীর্ণ অবস্থায় কক্সবাজারের পাহাড়ঘেঁষা ভূমিতে অবস্থান তাদের জীবনের ওপর হুমকি তৈরি করবে। তাই এক লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তরিত হলে তাদের নিজেদের মধ্যে কোন্দল কমে সদ্ভাব তৈরি হবে এবং বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলোর পক্ষে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনা করা সহজ হবে।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক
ctonmoy555@gmail.com